সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার তখনো বিকালের উচ্ছ্বসিত মনকে গ্রাস করতে পারেনি। কলরবের প্রতিধ্বনি হয়তো সবেমাত্র থেমেছে। পাহাড়ের ধমনী হতে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক গতিবেগ নেবে, এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে। মাঝিরা, শেষ জাল ফেলেছিল, তাই জলের পরিসীমা কমিয়ে নিজেদের আয়ত্বে আবার চেষ্টায় রত। পাখিদের বাড়ি ফেরা শেষ হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ সময়ের পর একত্রে বসার আনন্দে ঘন জঙ্গল মুখরিত করে তুলছে। দূরে ব্যস্ত শহরের কোলাহল একেবারে ক্ষীন হয়ে পাহাড়ের হৃদয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, ঠিক যেমন খরস্রোতা নদী সমস্ত বেগ হারিয়ে সমুদ্রের সাথে মিশে যায়, নিজের তীব্রতা যেন এক লহমায় হ্রাস হয়।
আমার এইসব প্রতিদিন দেখতে ভাললাগে। দুপুরের তীব্র গমগমে পরিবেশ কেমন ধীরে ধীরে চুপ হতে থাকে, টা পাহাড়ের কোলে বসেই অনুভব করা যায়। মানুষ, সমাজ, উত্তেজনা, ব্যস্ততা এসব সময় আর আলোর সাথে সাথে লুকোচুরি খেলা খেলে।
সেগুন বা চন্দন গাছের গুরুত্ব পাহাড়ের গভীরতর সাথে মিশে যায়, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের চুড়ো শুধুই সবুজ, আর মিশে যাওয়া সম্মিলিত উদ্যোগ।
সেইরকমই মানুষের আহামরি আর আমিত্বের মহীরুহ, ব্যস্ততার দিবালোকে যতটা গর্জন করে, সেইরকমই নিরুপায় আর ক্ষুদ্রের ভূমিবরণ পরিলক্ষিত হয় সেই পাহাড়ের চুড়া থেকে।
আমার পাহাড়ে যেতে ভালো লাগে। এক পাহাড় থেকে যখন অন্য পাহাড়ের চুড়ো দেখা যায়, ভাবি এদের মধ্যে দুরত্ব অনেক হলেও, সমষ্টিগত ভালোবাসা অপরুপ। ময়ূর যেমন, ময়ূরীর ভালোবাসা পেতে পেখমের সৌন্দর্যে অভিভূত করে, পাহাড়ও বক্ষে ধারণ করা বৃক্ষ, পাখির কুজনে মর্মরিত করে তোলে চারিপাশ। মেঘেদের থামিয়ে বৃষ্টি মেখে নেওয়া, সূর্যের রশ্মিতে নিজেকে উদ্ভাসিত করা, রংবেরঙের ফুলের ডালি সাজিয়ে যেন, প্রিয়তমাকে প্রতি মুহূর্তে ভালোবাসার ভাষার বহিঃপ্রকাশ করতে চাই ।
সন্ধ্যে এক মুহুর্ত, সন্ধ্যে এক না বলা গল্পকথার আসর। সন্ধ্যে এক মুহূর্তের উন্মাদনা, ভবিষ্যতের জলছবি, সন্ধ্যে যেন অতীতকালের না বলা জমে থাকা গল্প। আর পাহাড় সেইসব না বলা গল্পের ডায়েরি।