সেই ছেলেটি।।
(হাসপাতালে থাকাকালীন)
শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের চেষ্টাতে সেই রোগিটিও বাঁচলো না। CPR করছিল খুব জোরে জোরে। পাশের নার্স উদ্বিগ্ন হয়ে সাহায্য করছিল। আমি তখন তিনটে বেডের দূরত্বে খানিকটা হতাশা মুখে একভাবে তাকিয়ে রয়েছি।
আমি জানি না তাকে। হাসপাতালে কত রোগী আসে আর কত রোগী যায় তার হিসাব রাখা দূর্দায়। কিন্তু রাত্রে নিজের কষ্ট নিয়ে যখন ঘুমকে বিদায় জানিয়েছি, তখন চারিদিকে মানুষগুলোকে একটু করে দেখে নিচ্ছি। আসলে এর ফলে নিজেকে কিছুটা সান্তনা দেওয়া যায়। নিজেকে বলা যায়, আমি শুধু একা রোগ ভোগ করছি না, হাসপাতালের কষ্ট নিচ্ছি না, আমার মতো অনেকে তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত।
বেশিক্ষন দেখতে পারছিলাম না কাউকে। কারন আমি খুবই অসুস্থ। আর সত্যি বলতে খুব একটা ভালো লাগছিল না। আমার উল্টো দিকের বেডের রোগীটা মারা গেছে দুপুরে। তার তিনটে মেয়ে। বাড়িতে তেমন কেউ নেই। তাই তার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ারও কেউ নেই। নার্স একবার চিৎকার করে গেল। পরে সেও চুপ হয়ে গেল। স্যালাইনটা অনেকক্ষন আগেই বন্ধ হয়ে গেছিল। এবারে হাত থেকে খুলে নিল। মুখে সাদা কাপড় দিয়ে চলে গেল একটা কমবয়সী ছেলে।
এবারে সেই রোগীটির পাশে একটি কমবয়সী ছেলেকে লক্ষ্য করলাম। আগে থেকে ছিল কিন্তু আমি অতটা খেয়াল করিনি। আসলে চোখের সামনে কাউকে মৃত্যুর সাথে লড়তে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। তাই অতটা লক্ষ্য করা হয়নি।
দেখলাম ছেলেটিকে ডাক্তার বললো, 98% চান্স নেই। তবু আমি চেষ্টা করছি। এই বলে নার্সকে দুটো ইঞ্জেকশন আনতে বললো। নার্স একটা স্টাফকে বলে দৌড়তে লাগলো। ছুটে ছুটে নিয়ে আসলো। সঙ্গে সঙ্গে তা শরীরে দিয়ে দিল। আমি একভাবে দেখছি। পাশে দাদা ছিল আমার সাথে। সে আমায় শুয়ে পড়তে বললো। আমি "হুঁ" বলে আবার দেখতে লাগলাম।
চোখের সামনে মৃত্যু আমি দেখেছি। সে ভয়ানক মৃত্যু। বর্ধমান মেডিকেল কলেজে দেখেছি। অনেকদিন কেমন সেই স্মৃতিতে থাকতাম। ভয়ানকভাবে আমায় নাড়িয়েছিল। আমি এই জন্যেই হয়তো ডাক্তার হতে পারিনি। কারন নার্ভের ক্ষমতা ডাক্তার হতে গেলে যা দরকার তা আমার নেই। কিন্তু মানুষ হিসাবে আমি চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখতে পারিনা।
যাইহোক, সেই ছেলেটি হলো রোগিটির ছেলে। বাবাকে চোখের সামনে দেখছে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে। ডাক্তার বারবার বলছে চান্স খুব কম। ছেলেটাও কেমন পাল্টে যাচ্ছে। এদিক সেদিক দেখছে। আবার ডাক্তারের দিকে তাকাচ্ছে।
আমি একবার শোবার চেষ্টা করলাম। কারন কোমরে যন্ত্রনা করছে। পাশ ফিরে শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। শুধু মনে মনে সেই যুদ্ধক্ষেত্র লক্ষ্য করলাম। কি ভীষণ ভয়ঙ্কর যুদ্ধক্ষেত্র। যেখানে একদিকে প্রাণবায়ু বেরনার উপক্রম। আর একদিকে জন্মের সমস্ত স্মৃতি, আদর, ভালোবাসা, মায়া, বন্ধন, সুখ, দুঃখ, শান্তি সবকিছু যেন বেষ্টনী করে রেখেছে। যাকে ভেদ করে স্বাভাবিক থাকা অসম্ভব মনে হলো।
সেই যুদ্ধক্ষেত্রে সেই ছেলেটিকে দেখলাম, অভিমুন্যের মতো নিরস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। যেন তার সীমাবদ্ধতা জেনে গেছে। তাই তার সমস্ত বাধাগুলোকে যেন বর্মের মতো নিজের শরীরে পরে নিচ্ছে।
ক্রমশ.........
إرسال تعليق